
মানব পাচার থেকে ফিরে আসা নারী ও পুরুষদের পুনর্বাসন এবং সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে শরীয়তপুরে অনুষ্ঠিত হলো এক সমন্বয় সভা। ‘আশ্বাস : যারা মানব পাচারের শিকার হয়ে ফিরে এসেছেন তাদের জন্য’ শীর্ষক এ সভার আয়োজন করে শরীয়তপুর ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (এসডিএস), সহযোগিতায় উইনরক ইন্টারন্যাশনাল। এবং যার অর্থায়নে ছিল সুইজারল্যান্ড দূতাবাস।
সভায় মানব পাচার প্রতিরোধে বিভিন্ন উদ্যোগ, ভুক্তভোগীদের সহযোগিতা, গণমাধ্যমের ভূমিকা ও ডিজিটাল সেবা কেন্দ্রগুলোর করণীয় বিষয়ে বিশদ আলোচনা হয়।
বক্তারা বলেন, এই ধরনের সমন্বয় সভা মাঠপর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও কার্যক্রমের সমন্বয় সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। মানব পাচার শুধু একটি ফৌজদারি অপরাধ নয়, এটি একটি মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের নাম। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, শিক্ষা ও সুযোগের অভাব, জলবায়ু পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাও মানব পাচারের অন্যতম কারণ।
সভায় জানানো হয়, বাংলাদেশ থেকে পাচারের শিকারদের একটি বড় অংশ নারী ও শিশু। বিশেষ করে নারীরা অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে বিদেশে কাজের আশায় প্রতারণার ফাঁদে পড়েন। পাচারকারীরা তাদের চুক্তিভিত্তিক কাজের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে শোষণের শিকার করেন।
বক্তারা আরও বলেন, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার এবং নিরাপত্তার অভাব বাংলাদেশিদের আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। তাই শুধু উদ্ধার করাই যথেষ্ট নয়, বরং ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের সচেতন করা, সমাজে পুনর্বাসন এবং মানসিক ভাবে তাদের শক্তি ফিরিয়ে দেওয়া প্রকৃত প্রতিরোধের পথ।
উইনরক ইন্টারন্যাশনালের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী এটিএম মাজহারুল ইসলাম বলেন, “সুইজারল্যান্ড সরকারের অর্থায়নে আমরা বহু বছর ধরে মানব পাচার প্রতিরোধে কাজ করছি। জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আমরা জারীগান, পথনাটকসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করি। স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে বিশেষ কার্যক্রম চলছে, কারণ এদের মধ্যে বিদেশ যাওয়ার আগ্রহ বেশি এবং অল্প বয়সে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা থাকে।”
তিনি আরও বলেন, শরীয়তপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। যারা পাচারের শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন, তাদের আইনি সহায়তা, মানসিক সহযোগিতা ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।
প্রকল্প ব্যবস্থাপক এস এম জাকির হোসেন বলেন, “আমরা আমাদের কার্যক্রম গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত করেছি। কৃষক, দিনমজুর, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকল স্তরের মানুষকে মানব পাচারের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করছি। অবৈধভাবে বিদেশে গিয়ে যারা নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে এসেছেন, আমরা সবসময় তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি।”
তিনি আরও বলেন, “কোনোভাবেই নিজের জীবন বা পরিবারকে বিপদে ফেলে অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়া যাবে না। যারা বিদেশে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে ফিরে আসেন, তাদের খবর কেউ রাখে না, অথচ যাদের বাড়ি-গাড়ি হয়, তাদের নিয়েই আলোচনা হয়। আমরা সেই উপেক্ষিত ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়িয়েছি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি।”
সভায় দ্য ডেইলি স্টারের শরীয়তপুর ও মাদারীপুর প্রতিনিধি জাহিদ হাসান বলেন, “আশ্বাস প্রকল্পের পক্ষ থেকে গণমাধ্যম কর্মীদের কোনো তথ্য বা সহযোগিতার প্রয়োজন হলে, আমরা সবসময় প্রস্তুত আছি। মানব পাচারবিরোধী মামলায় যেন নিরীহ কাউকে আসামি না করা হয়, সেদিকে প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে হবে। তা না হলে আসল অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে।”
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন অফিস ও পৌর ও ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার কর্মকর্তাদের অনুরোধ করে বলছি, যেন কেউ বিদেশগামীদের বয়স কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে না দেন। বিদেশে গিয়ে ডাক্তারি পরীক্ষায় বয়স ধরা পড়লে তারা বৈধ হয়েও অবৈধ হয়ে যান।”
পরিশেষে তিনি ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে উদ্দেশ করে বলেন, “ঋণগ্রস্ত হয়ে, জমিজমা বিক্রি করে অবৈধভাবে বিদেশে গিয়ে নিজেকে ও পরিবারকে নিঃস্ব করবেন না। বৈধ পথে বিদেশে গেলে আপনি ও আপনার পরিবারের সবাই নিরাপদ থাকবেন।”
‘আশ্বাস প্রকল্প ব্যবস্থাপক এস এম জাকির হোসেন এর সঞ্চালনায় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মোঃ খালেদ মিয়া জেলা লিগাল এইড অফিসার (সিনিয়র সরকারি জজ) শরীয়তপুর। এসডিএস-এর সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুজিবুর রহমান মাদবর। সভায় উপস্থিত ছিলেন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটির (সিটিসি) সদস্যবৃন্দ, মানব পাচারবিরোধী কর্মী, ইউনিয়ন ডিজিটাল কেন্দ্রের (ইউডিসি) প্রতিনিধি এবং স্থানীয় সাংবাদিকগণ।
দৈনিক হুংকারে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।