Monday, 12th May, 2025

কার্তিকপুরের মৃৎশিল্প সামগ্রী রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে

প্লাস্টিক, এ্যালোমিনিয়াম ও স্টীল সামগ্রীর দাপটে যখন দেশের মৃৎ শিল্প মুখ থুবরে পরেছে, হারিয়ে যেতে বসেছে পৃথিবীর আদি এ শিল্পটি, সে সময়ে শরীয়তপুরের কার্তিকপুরের মৃৎ শিল্পীদের তৈরী পন্য দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে যাচ্ছে ইউরোপ, আামেরিকা সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।
দেশ ব্যাপি মৃৎ শিল্পীরা যখন অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় পরে হারাতে বসেছে তাদের পৈত্রিক পেশা। এমনি সংকটকালে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কার্তিপুরের মৃৎ শিল্প পল্লীতে প্রায় সহস্রাধিক বেকার যুবক ও যুব মহিলাদের কর্মসংস্থান হয়েছে। শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী কার্তিকপুর গ্রামটি বর্তমানে মৃৎ শিল্পের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে সুখ্যাতি অর্জন করেছে।
এ গ্রামের পাল বংশের লোকদের আদি পেশা মাটি দিয়ে ঘর গৃহস্তালির বিভিন্ন বাসন কোশন, কলস, টালি, মটকা, হাড়ি, পাতিল, বদনা সহ অনেক তৈজষপত্র তৈরী করত। বর্তমানে তারা এসব পণ্য তৈরীর পরিবর্তে আধুনিক বিশ্বের চাহিদা অনুযায়ী সৌখিন সামগ্রী ট্যারাকোটা, টাইলস, মোমদানী, ফুলদানী, ফুলের টব, নাইট ক্যান্ডেল, কয়েন বক্স, সিনারী ওয়াল প্লেট, ক্যাকট্রাস টব, ওয়াল প্লাস্টার, ওয়াল টব, কলমদানী, ভিজিটিংকার্ড বক্স, খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বীদের নেইটি বেইটি হাউজ, মা মেরীর মূর্তি, ক্রিসমাস হ্যাংগিং রিং সহ অন্তত ৩শ ধরনের শো পিচ। বংশ পরম্পরায় এ কাজ করে আসছে কুমার বা পালেরা। স্বাধীনতার পর থেকে এই পাল বংশের কেউ কেউ আধুনিকতার অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে কার্তিকপুরের মৃৎ শিল্পে। এই এলাকার উৎপাদিত শিল্প সম্ভার আজ সমাদৃত হয়েছে ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের ২০টি দেশ সহ পৃথিবীর অনেক দেশে অর্জিত হয়েছে সুনাম আর সুখ্যাতি। তবে সরকারের সঠিক তদারকি আর পৃষ্ঠপোশকতা না থাকায় কার্তিকপুরের মৃৎ শিল্পীদের নির্ভর করতে হয় মধ্যস্বত্তভোগী বায়ার বা বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার উপর। তাদের আক্ষেপ, তারা কারিগরই রয়ে গেল কিন্তু ব্যবসায়ী হতে পারলো না। কার্তিকপুর গ্রামের সমীর পাল, প্রদীপ পাল, সন্দীপ পাল, রঙ্গদীপ পাল, গোবিন্দ পাল, জওহর লাল পাল ও উত্তম পালের ৩টি ফ্যাক্টরী রয়েছে মাটির আধুনিক পন্য তৈরীর জন্য। এ সকল পন্য তৈরী করার জন্য পরিবারের লোকদের বাইরেও রামভদ্রপুর, ডিঙ্গামানিক ও কার্তিকপুর গ্রামের প্রায় সহস্রাধিক বিভিন্ন বয়সের শ্রমিক, বিশেষ করে নারী শ্রমিকেরা কাজ করে। বে-সরকারী উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) কারিতাস, হীড বাংলাদেশ, উষা হ্যান্ডিক্রাফটস, ঢাকা হ্যান্ডিক্রাফটস ও আড়ং এর মত অনেক প্রতিষ্ঠান কার্তিকপুরের মৃৎ শিল্প পল্লীতে এসে উল্লেখিত পন্য তৈরীর জন্য অর্ডার দিয়ে থাকে। আর কার্তিকপুরের তৈরী পণ্যতেই ঐ সকল প্রতিষ্ঠানের পন্যগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন শহরের নামী দামী মার্কেট ও মেলায় বিক্রি করে। বেশীর ভাগ পন্য তারা ইউরোপ মহাদেশের সর্বত্র, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতে রপ্তানী করে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব লোগো এসকল পন্য উৎপাদন কালিন সময়ে পন্যের গায়ে এটে দেয়। বছরের পুরো সময় ধরেই মৃৎ পল্লীতে কাজের চাপ থাকে। দেড় ইঞ্চি থেকে শুরু করে ৬ ফিট আকারের এবং ৩ টাকা থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকা মূল্য মানের বিভিন্ন পন্য বা সোপিচ এখানকার মৃৎ শিল্পীরা তৈরী করে থাকে। মৃৎ শিল্পী রঙ্গদ্বীপ পাল জানান, প্রথমে তারা দোয়াশ মাটি সংগ্রহ করে। এই মাটি পানির সাথে মিশিয়ে তরল করে মাটি ও পানির তরল অংশ জার্মান থেকে আমদানী করা বিশেষ ধরনের জালি (নেট) দিয়ে ছাকা হয়। এর পর ২০ দিন পর্যন্ত বিশেষ পাত্রে ঝুলিয়ে রেখে পানি ঝড়ানো হয়। পানি ঝড়া শেষ হলে তাকে মুন্ডু বলা হয়। এই মুন্ডু রোদে শুকিয়ে তা আবার পানি মিশিয়ে নরম করে তা দিয়ে নক্শা অনুযায়ী মূল পন্য তৈরী করা হয়। তৈরী কাঁচা পন্য সরাসরি রোদে শুকিয়ে আগুনে পোড়ানো হয়। পরে ঐ সকল সংস্থা পছন্দ মত রং করে এরপর ব্যবহার উপযোগী করে বিক্রির জন্য তুলে দেয় দেশীয় ও বিদেশী ক্রেতাদের হাতে। মৃৎ শিল্পী সন্দীপ কুমার পাল জানান, তাদের বংশ পরম্পরার পেশা মাটির তৈরী বিভিন্ন পণ্য তৈরী ও বিক্রি করা। ১৯৭৬ ভধুবৎ ঁস নষড়ম সালে ঢাকা আর্ট কলেজের একজন শিক্ষকের উৎসাহ ও অনুপ্রেরনায় তারা সর্ব প্রথম মাটির তৈরী আধুনিক পন্য তৈরী করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিক্রি করা শুরু করে। পাশাপাশি বিভিন্ন মেলায় অংশ গ্রহণ করে। এর পর থেকে তাদের নির্মিত পন্যের মান দেখে ক্রমেই তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে থাকে কয়েকটি সংস্থা। তিনি বলেন, তাদের উৎপাদিত এই পন্যগুলো চুক্তিবদ্ধকারী প্রতিষ্ঠান দেশের বড় বড় প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করে এবং বিদেশে রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। সমীর মৃৎ শিল্পের সত্বাধিকারী প্রদীপ কুমার পাল বলেন, তাদের বড় ভাই সমীর কুমার পাল ভারতে থাকেন। সেকান থেকে বিভিন্ন বিদেশী ডিজাইন সংগ্রহ করে পাঠালে সে অনুযায়ী তারা পন্য তৈরী করেন। তাদের প্রতিষ্ঠানে মাত্র ১০/১২ লক্ষ টাকা মূলধন রয়েছে। ঢাকার যে সকল প্রতিষ্ঠান তাদের পন্য বানিয়ে নেয় তারা বছরে প্রায় ৩০/৪০ লাখ টাকার অর্ডার দেয়। পার্শবর্তী দুইটি ফ্যাক্টরীতেও অনুরূপ পন্য তৈরীর অর্ডার দেয়া হয়। এই পল্লী থেকে বছরে প্রায় কোটি টাকার মৃৎ পণ্য তৈরী করে সরবরাহ করা হয়। তাদের ১ ফিট মাপের ১টি পন্য যেমন নাইট ক্যান্ডেল (পরী) তৈরী করতে মাটি, শ্রমিক সহ ৬০ টাকা খরচ পরে, কিন্তু বিক্রয় করা হয় মাত্র ৭৫ টাকা। অথচ এর একটা নাইট ক্যান্ডেল ঢাকায় বিক্রি করা হয় আড়াইশত থেকে তিন শত টাকা। বিদেশে কম পক্ষে ২০ ডলার। তারা ৫-৭ ফুট লম্বার একেকটি হাতি নির্মাণ করে পায় ১৫-১৮ হাজার টাকা। আর এগুলো ঢাকায় বা এর বাইরে বিক্রি হয় ৩৫-৪০ হাজার টাকায়। স্বপন পাল জানান, তাদের ৪ ভাইয়ের যৌথ পরিবারের এই শিল্পের কাজ করে আয় হয় মাসে মাত্র ৪০/৫০ হাজার টাকা। ৩০ বছর যাবৎ এ কাজ করে দেশ বিদেশ থেকে অনেক সুনাম অর্জন হয়েছে বটে কিন্তু ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। অনেক বার ঢাকার জাতীয় যাদুঘরে প্রদর্শনীতে অংশ গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় সনদও পেয়েছেন কিন্তু তাদের নিজ পায়ে দাড়ানোর সহায়তার আশ্বাস কেউ দেয়নি। তিনি বলেন, নিজেদের এ ব্যবসা করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন। এজন্য ঢাকাতে অফিস, শো-রুম থাকতে হয়। বিদেশী বায়ারদের সাথে চুক্তি করতে পারলে আরো অধিক পন্য তৈরী করে রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। আর এজন্য প্রয়োজন সরকার বা কোন প্রতিষ্ঠানের কার্তিকপুরের মৃৎ শিল্পিদের পাশে এগিয়ে আসা। ডিঙ্গামানিক গ্রামের মৃৎ শ্রমিক মালতি রানী (২২) জানান, তিনি কিশোরী বয়স থেকে মৃৎ শিল্পের কাজ করেন। কখনো স্থায়ী কখনো খন্ডকালিন কাজ করে মাসে প্রায় সাড়ে তিন থেকে ৫ হাজার টাকা রোজগার করেন। মৃৎ শ্রমিক সোহানা (১৭), পারভীন (১৮) ও অর্চনা (১৮) জানায় তারা স্কুলে লেখা পড়া করার সময় থেকেই পাল বাড়ির মৃৎ শিল্পের খন্ডকালিন কাজ করতো। নিজেদের লেখা পড়ার খরচ বহন করার পরও তারা কাপড় চোপড় ও প্রসাধনীর অর্থ এই পারিশ্রমিকের আয় থেকে বহন করতো। এখনো তারা প্রত্যেকে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৪ হাজার টাকা আয় করছে বলে জানায়। কার্তিকপুর পাল পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মিলন কুমার দাস বলেন, পালেদের তৈরী মাটির পন্য এতটা মান সম্মত যে, কেউ কাছে এসে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবেনা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহন না করেও কেউ বিশ্ব নন্দিত এত সুন্দর পন্য উৎপাদন করতে পারে। তিনি বলেন, এখানকার পালদের পূঁজি থাকলে তারা নিজেরাই এ পন্য গুলো বিদেশে রফতানী করে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বি হতে পারতো। রামভদ্রপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিপ্লব সিকদার বলেন, যুগের পর যুগ ধরে কার্তিকপুর গ্রামের পালেরা মৃৎ শিল্পের কাজ করে আসছে। তাদের সুনাম রয়েছে দেশে বিদেশে। তাদের উৎপাদিত পন্য বিদেশে পাঠিয়ে এর লভ্যাংশ নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু সরকার যদি এই সম্প্রদায়কে আর্থিক সহায়তা প্রদান করতো তা হলে তারা নিজেরা স্বামলম্বি হওয়ার পাশাপাশি শরীয়তপুরের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে সুনাম আরো বৃদ্ধি করতে পারতো।

সংবাদটি শেয়ার করুন

দৈনিক হুংকারে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।