
আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন খবর পড়ছি বা শুনছি করোনা রোগী মাকে ছেলেরা বনে ফেলে গেছে বাবাকে রুমের ভেতর আটকিয়ে রেখে মৃত্যুর পূর্বে পানি পর্যন্ত দেয়নি। আজও দেখলাম বাবা মা রুটি পানি দিয়ে গভীর রাতে জঙ্গলে ফেলে গেছে আদরের ছেলেকে। কোন বাসা বা বাড়িতে করোনা রোগী থাকলে পাড়া প্রতিবেশী সবাই অমানবিক আচরন করছে। দরজা জানালা খুলতে দেয় না। নারায়ণগঞ্জে এক বিল্ডিংয়ে একজনকে কেউ পানি দিয়েও সাহায্য করেনি পরে অসহায় বৌ মেয়েদের সামনে সিড়িতেই মৃত্যুবরন করে। শরীয়তপুরের নড়িয়াতে এরকম ঘটনা শুনেছি বাসার দরজা জানালা খুলতে পারছে না। কোথাও কোথাও করোনা রোগীর লাশ দাফন করতে দেয়নি। এইসব নির্মম ও নিষ্ঠুর ঘটনাগুলো আমাদের অনেকেরই মন কাঁদায়, নাড়া দেয় হৃদয়। নিজেরা বেঁচে থাকার জন্য এতো নির্দয় নির্মম আচরন আমরা করছি আপনজনদের সাথে। মৃত্যুর ভয়ে আমরা এতো বেশী স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি, ভূলে যাচ্ছি রক্তের টান পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন। কিন্তু একটি বার ও ভাবছি না এরপরও কি আমরা করোনা মুক্ত থেকে সুস্থ থাকতে পারব, বেঁচে থাকতে পারব! বাঁচা মরা তো মহান আল্লাহর হাতে। আমাদের সাবধান থাকতে হবে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে কিনতু মানবিক দুরত্ব তো নয়। আমরা যেন ভুলে না যাই যে আমরা সামাজিক জীব। আমাদের মানবিক গুনাবলী আছে আর তা হারালে চলবে না, ধারন করতে হবে।
কিছু কিছু নির্মম ঘটনার মধ্যেও বহু মানবিক ঘটনার উদাহরণ ও আমাদের কাছে আছে। তেমনি একটি ঘটনার কিছুটা সকলের উপকারার্থে তুলে ধরছি। আমার শিক্ষা ক্যাডারের এক বান্ধবী জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রামপুরায় বাসা। উনার মায়ের করোনা পজিটিভ রেজাল্ট আসল। দুই বোনের একজন কাজের সুবাদে ঢাকার বাইরে লকডাউনের পুরো সময়টা। ভাইয়ের ছোট বাচ্চা থাকার কারনে তাদেরকে বেশ সাবধানেই থাকতে হলো। মায়ের পাশে থাকার জন্য বান্ধবীটা সিদ্ধান্ত নিয়ে মানসিক ভাবে শক্তি সঞ্চয় করল। করোনায় আক্রান্ত মাকে খাওয়া গোসল হাটানো বাথরুম বাসা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ধোয়া মোছা রান্নার সব কিছু একাই করেছে। শক্ত খাবার খেতে পারে না বলে সব সময় খাবার ব্লেন্ড করে নিজ হাতে মাকে খাইয়ে দিয়েছে। গোসল করিয়েছে। রাত্রি জেগে মায়ের পাশে মাকে পাহারা দিয়েছে। শ্বাস কষ্ট কখন বাড়ে কমে সারাক্ষন পর্যবেক্ষন করেছে। লং আদা তেজপাতা লবন ইত্যাদি দিয়ে গরম পানি করে বারবার গরগরা করা ও খাওয়ানো সব কিছুই সাবধানতার সাথে নিজ হাতে করেছে। এখন আল্লাহর রহমতে মা সহ তারা সবাই পুরোপুরি সুস্থ।
আমার খালুর পাশে সারাক্ষন খালা আর খালাতো বোন সেবা দিচ্ছে। সার্বক্ষণিক পারিবারিক সেবা ও মানসিক শক্তি সাহস যোগানের কারনে আস্তে আস্তে সুস্থ হচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ্ এবং পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
ক্যান্সার, হেপাটাইটিস বি, যক্সা ইত্যাদি মারাত্মক রোগের ক্ষেত্রে আমরা সবাই সেবা করি পাশে থাকি সাহস দেই। করোনা তেমনি একটা রোগ হয়তবা ছোঁয়াচে বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয় কিন্তু এ রোগের রোগীরা ও মানুষ। এদের ও মন আছে এদের ও সেবার প্রয়োজন হয়। এ রোগীর আরো বেশী সেবার দরকার হয়। যেহেতু এখনও কোন ঔষুধ আবিস্কার হয়নি সেহেতু পারিবারিক পথ্য আদা লং গরম পানি পুষ্টিকর খাবার সাহস ইত্যাদি দিয়েই আল্লাহর রহমতে করোনার মুক্তি মিলে। তাই পারিবারিক সেবা আর সাহস করোনা রোগী বেঁচে যাওয়ার অন্যতম উপায়। ডাক্তারী ভাষায় বলে একজন রোগীর মানসিক সুস্থতা শারীরিক সুস্থতার অর্ধেকও বেশী। যেকোন মারাত্মক রোগীকে যদি মানসিকভাবে সুস্থ হাসি খুশি রাখা সম্ভব হয় তাহলে তার রোগ ও অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। করোনা রোগীর ক্ষেত্রে সামাজিক সাপোর্ট অত্যন্ত জরুরী। মনে রাখতে হবে সামাজিক সমস্যার কারনে যাতে রোগীর মানসিক সমস্যা সৃষ্টি না হয়।
এইসব ক্ষেত্রে মাদার তেরেসা আমাদের জন্য একটি অনুকরনীয় উদাহরণ।
প্রয়োজনে হাসপাতালে তো যেতেই হবে। তবে এও মনে রাখতে হবে যে সরকারের শত চেষ্টার পরও আমাদের বর্তমান প্রয়োজন অনুযায়ী হাসপাতালে করোনা বেড, অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর ইত্যাদি পর্যাপ্ত পরিমান সাপোর্ট দেয়া কষ্টকর হচ্ছে। তাই বাসায় থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলাই উত্তম মনে হচ্ছে। তথ্য গোপন না করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে করোনা সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে হবে। মনে রাখতে হবে করোনা হলে লজ্জা পাওয়ার কিছু নাই। এটা অন্যান্য রোগের মতোই একটি রোগ।
করোনা রোগীকে ভয় অবহেলা না করে সাহসের সাথে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পারিবারিকভাবে যথাযথ সেবা প্রদান করে সুস্থ করা সম্ভব। তাই সকলের কাছে অনুরোধ করোনা রোগীর জীবন বাঁচাতে মানবিক হই, সাপোর্ট দেই, সাহস দেই, ভয় নয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে সেবা দিয়ে জয় করি করোনাকে।
-তালুকদার মোঃ ফারুক আহম্মেদ, ভাইস প্রেসিডেন্ট, মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড, হেড অফিস, ঢাকা
দৈনিক হুংকারে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।