
বর্ষা বান্ধব বাহন নৌকার প্রয়োজনীয়তা কমে গেলেও গুরুত্ব একে বারে হারিয়ে যায়নি। তাইতো বাংলা সনের জৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি থেকে নৌকা তৈরীর কারিগরদের হাতুড়ি বাটালের টুকটাক শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে শরীয়তপুর সদর উপজেলার রুদ্রকর ইউনিয়নের চন্দনকর গ্রাম।
বৃষ্টির দিনে নিচু এলাকায় নৌকার গুরুত্ব অনেকাংশেই বেড়ে যায়। এ কারণে বর্ষা শুরুর আগেই নৌকা বানানোর ধুম পড়ে। শুধু বর্ষা কেন্দ্রিক নয়, সারা বছরই নৌকা বানান শরীয়তপুর সদরের রুদ্রকর ইউনিয়নের চন্দনকর গ্রামের লোকেরা। বর্তমানে নৌকার ব্যবহার কমে গেলেও আদি আমল থেকেই নৌকা বানিয়ে আসছেন এই গ্রামের মানুষ।
কালের বিবর্তনে অনেকেই এই পেশা ছেড়ে চলে গেছেন। তবে পৈত্রিক পেশা হিসেবে অনেকেই নৌকা তৈরী করে যাচ্ছেন। শরীয়তপুর সদরের এই গ্রামটির ১০টি পরিবার, পাশ্ববর্তী ভেদরগঞ্জ উপজেলার ছয়গাঁও ও আটেরপাড়ার ৮টি পরিবার এবং মহিষার ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের ২টি পরিবার এখনো নিয়মিত নৌকা তৈরি করছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিচু অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিল শরীয়তপুর। বর্ষার দিনে বিলের পর বিল জলমগ্ন থাকতো। তখন বছরের ছয় মাস পানির নিচে থাকত এই অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা। তখন থেকেই মানুষের চলাচলের জন্য ব্যবহার হতো নৌকা। আর জেলায় ব্যবহৃত নৌকা বেশির ভাগই এই গ্রামগুলো থেকে কিনে নিয়ে যেতেন ক্রেতারা। এখানে নৌকা বানানো হয় বলে তখন থেকেই এলাকাটি ‘নৌকা গ্রাম’ নামে পরিচিতি পায়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রুদ্রকর ইউনিয়নের চন্দনকর এলাকায় নৌকা তৈরির কাজ চলছে পুরোদমে। ঘরের পাশেই খোলা বড় জায়গায় নৌকা বানানোর কাঠ রাখা। সেখানে কাজ করছেন কয়েকজন নৌকা বানানোর মিস্ত্রি বা কারিগর। এখানে ছোট থেকে বড় সব বয়সী মানুষকেই নৌকা বানানোর কাজ করতে দেখা যায়।
মিস্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি ছোট নৌকা বানাতে দুই দিন সময় লাগে। আর বড় হলে তিন দিনের প্রয়োজন হয়। আগে কাঠের দাম কম হওয়ায় নৌকা বানাতে তেমন খরচ পড়ত না। বিভিন্ন মালামাল কিনে ছোট নৌকা বানাতে এখন ছয় থেকে আট হাজার টাকা গুনতে হয়। এ কারণে ক্রেতারা কিছুটা হিমসিম খাচ্ছেন। সবকিছুরই দাম এখন বেশি। এবছর ছোট আর মাঝারি সাইজের নৌকার বেশি চাহিদা। বড় নৌকা বানাতে যে খরচ, তার থেকে কিছুটা কম খরচ হয় মাঝারি সাইজের নৌকা বানাতে।
নৌকা ক্রেতাদের কয়েক জনের সাথে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে এই গ্রামেই নৌকা বানানোর কাজ করে যাচ্ছে কিছু পরিবার। তাদের মাধ্যমেই এই জেলার বিভিন্ন প্রান্তে নৌকা তৈরি করে নিয়ে যাচ্ছেন ক্রেতা বা নৌকা বিক্রেতারা। আগে তিন থেকে চার হাজার টাকা দিয়ে বড় একটি নৌকা পাওয়া যেত। এখন সেই নৌকা কিনতে গুনতে হচ্ছে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা।
নৌকা মিস্ত্রী সঞ্জয় মন্ডল বলেন, বাবার সঙ্গে হাত ধরে কাঠের কাজ শিখেছি। আর অন্য কোনো কাজ করতে পারি না। এই নৌকার চাহিদা বছরে তিন থেকে চার মাস থাকে। এটির চাহিদা শেষের পর গ্রামে গিয়ে কাঠের কাজ করি। কিন্তু করোনা আসার পর কাজ নেই বললেই চলে। কষ্ট করে নৌকা বানিয়ে সংসার চালাতে হয়।
আরেক মিস্ত্রী ফুর্তি মৃধা বলেন, বাবা দাদারা এই কাজ করতেন। তাদের কাছ থেকে শিখেছি। একটি নৌকা বানাতে সময় লাগে দুই থেকে তিন দিন। আগে একটি নৌকা বিক্রি করলে দুই হাজার টাকা লাভ হতো। আর এখন একটি নৌকা বিক্রি করলে হাজিরার টাকাটাও ওঠাতে অনেক কষ্ট হয়ে যায়। তারপরও কষ্ট করে বাপ দাদাদের পেশা ধরে রেখেছি।
নৌকা কিনতে আসা আনোয়ার হোসেন বলেন, নৌকা কিনতে এসে পড়েছি বিপাকে। কারণ জানতে চাইলে বলেন, নৌকার দামের গায়ে আগুন। পানিবন্দি হয়ে থাকতে হবে যদি নৌকা না কিনি। তার থেকে বড় কথা নৌকা না নিলে বর্ষায় গরু ছাগল না খেয়ে মরবে। বর্ষায় আমাদের পুরো এলাকা পানির নিচে ডুবে থাকে। মাঠে পানি থাকায় ঘাস পাওয়া যায়না। নৌকা থাকলে কচুরিপানা কেটে খাওয়াতে পারব।
রুদ্রকর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান ঢালী বলেন, চন্দনকর এলাকায় বেশিরভাগ মানুষ চার মাস নৌকা বানায়। বছরের বাকি সময় তারা অন্য কাজ করে। তারা বাহারি ডিজাইনে নৌকা বানান। তাদের নৌকা জেলার বিখ্যাত।
দৈনিক হুংকারে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।