
নির্বাচন নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন প্রশ্ন ও সমীকরণ থাকলেও ভোট দিয়ে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন শরীয়তপুরের ভোটাররা। ভোটাররা যোগ্য প্রার্থীর বিভিন্ন মাপকাঠি তুলে ধরার পাশাপাশি যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ প্রশ্নেও নানা শর্ত পূরণের কথা বলেছেন। এসবের মধ্যে আছে নির্ভুল ভোটার তালিকা, ভোটার সচেতনতা এবং সুষ্ঠ, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও জাল ভোটমুক্ত ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা।
ভোটারদের পাশাপাশি শরীয়তপুরের জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং নাহরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করছেন, যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সুফল নিশ্চিত হতে পারে।
গত কয়েকদিন জাতীয় সংসদের ২২১ শরীয়তপুর-১, ২২২ শরীয়তপুর-২ এবং ২২৩ শরীয়তপুর-৩ আসনের নানা পর্যায়ের জনমানুষের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেছে, তারা এবার অধীর আগ্রহে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছেন। সেজন্য এখন থেকেই অপেক্ষায় আছেন জেলার ১১ লক্ষ ৬ হাজার ৮৬৪ জন ভোটার। শরীয়তপুর জেলা নির্বাচন অফিসের তথ্য মতে জেলায় মোট পুরুষ ভোটার ৫ লক্ষ ৭৮ হাজার ৯৯৭, মহিলা ৫ লক্ষ ২৭ হাজার ৮৫১ ও হিজড়া ১৬ জন।
ভোটাররা যে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছেন, সেই যোগ্য প্রার্থীর মাপকাঠি কী? বয়স্করা প্রার্থীর ব্যক্তিগত সততা এবং উন্নয়নের দিকে বেশি নজর দিলেও তরুণ প্রজন্ম চায় এমন প্রার্থী যিনি সহজে তাদের সমস্যা উপলব্ধি করে সমাধানে সহায়তা করতে পারেন। পাশাপাশি ভিন্নমত ও ভিন্নদলের প্রতি সহনশীল প্রার্থীকেও গুরুত্ব দিতে চায় তরুণ প্রজন্ম।
শরীয়তপুর পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের কাগদী গ্রামের নতুন ভোটার আবিদ হাসান বলেন, ২০১৯ সালে ভোটার আইডি কার্ড পেয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথম ভোট প্রদানের জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছি। তবে বর্তমান সরকারি দল আওয়ামী লীগসহ সকল বড় দলের কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে উৎসবের আমেজে যাতে নতুন ভোট দেয়ার আনন্দটা উদযাপন করতে পারি সেই পরিবেশ তৈরি করা।
শরীয়তপুর পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের কাগদী গ্রামের দিনমজুর মো: গিয়াস উদ্দিন রাড়ী (৬২)। বেশ রাজনীতি সচেতন মানুষটি বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে ইতোমধ্যে মাঠে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, চায়ের আড্ডায় বসে নিজেদের প্রার্থীর পক্ষে কিছু লোক গুণগান গাইতে শুরু করেছেন। কারো কারো কাছে তাদের মতামত সঠিক মনে না হলেও রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত প্রভাবের কারণে সঠিক কথাও উপস্থাপন করা যাচ্ছে না। তাই এখন থেকেই যদি ওই সকল জায়গায় প্রার্থীদের কী কী গুণ থাকলে উপযুক্ত প্রার্থী বলা যায় মর্মে লিফলেটসহ উঠান বৈঠকের আয়োজন করা যায় তা হলে আমাদের জন্য বাছবিচার করে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে।
তাছাড়া টাকার বিনিময়ে যারা এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে চায় তাদের যদি প্রশাসনের পক্ষ থেকে নজরদারিতে রাখা যেতো তাহলেও তাদের দৌরাত্ম অনেকটা কমতো। আর ভোট প্রদানের সময়ে যদি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি থাকে, জাল ভোটের পরিমাণও অনেক কমে আসবে।
জেলার নড়িয়া উপজেলার নওয়াপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো: জাকির হোসেন মুন্সী বলেন, আমার ২২ বছরের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণের মূল অন্তরায় হিসেবে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাকে দেখে আসছি। যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্তও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাই রাজনৈতিক দলগুলো যদি প্রার্থী মনোনয়েনের ক্ষেত্রে সতর্ক দৃষ্টি রাখে তাহলেও যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের পথ অনেক সুগম হবে।
তিনি বলেন, আমার ইউনিয়নের দুই দিকে পদ্মা বেষ্টিত দুর্গম চরাঞ্চলের ৪৮টি গ্রামে সাড়ে ১৪ হাজার ভোটারের জন্য ৪টি ভোট কেন্দ্র। সাধ্যমতো যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নই হতে পারে ভোটারদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য অন্যতম উপায়। জেলার মূল-ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই জনগোষ্ঠীর জন্য ভোটের আগে ওই ভোটের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে সরকারি বেসরকারিভাবে ভোটার শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাও যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের জন্য সহায়ক ভুমিকা পালন করতে পারে।
শরীয়তপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সিনিয়র সাংবাদিক যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সমাদ তালুকদার বলেন, যে কোনো নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনে সচেতন ভোটাররাই কেবল সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে তুলনামূলক উন্নত ও আধুনিক এলাকার ভোটারদের চেয়ে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল, চরাঞ্চল ও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার এলাকার ভোটাররা একটু পিছিয়ে থাকেন। তাই নির্বাচনের আগে নির্বাচনে ভোটারদের ভোটের গুরুত্ব ও কার্যকরিতা বিষয়ে সচেতন করতে ভোটার শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে সুফল পাওয়া যাবে।
ভোটার ও জনপ্রতিনিধিদের এমন ভাবনার মধ্যে ইতোমধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর দৌড়-ঝাপ শুরু হয়ে গেছে। স্থানীয় পর্যায়ে দলগুলোর মধ্যেও যোগ্য প্রার্থী নিয়ে আলোচনা চলছে।
শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, প্রবীণ রাজনীতিবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রব মুন্সী বলেন, নির্ভুল ভোটার তালিকা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনবান্ধব প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষমতা ভোটারদের কাছে সংরক্ষিত থাকে। তাই দলীয় মনোনয়নের সময় দলগুলো যদি একটু ভেবেচিন্তে যোগ্য প্রার্থীদেরকে মনোনয়ন দেন তাহলে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ অনেকগুণ বেড়ে যাবে। জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হলে যেমন সঠিক ও নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন অপরিহার্য, তেমনি যে কোন নির্বাচনের আগে ভোটার সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সম্মিলিতভাবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাটাও জরুরী। নির্বাচন একপাক্ষিক কাজ নয়।
শরীয়তপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও শরীয়তপুর-১ (২২১) এর সাবেক সংসদ সদস্য সরদার একেএম নাসির উদ্দিন কালু বলেন, নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের অন্যতম উপায় হচ্ছে সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। তাই আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারের জন্য সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আজ দেশে গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। আমরা আশা করছি সকল প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন হবে সকল দলের অংশগ্রহণমূলক। আর এর মধ্যদিয়ে দ্বাদশ সংসদে যোগ্য প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশ পরিচালনা করবে।
এ বিষয়ে জেলা নির্বাচন জেলা নির্বাচন অফিসার মো: সোহেল সামাদ বলেন, শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনই নয় যে কোন নির্বাচন গ্রহণ প্রক্রিয়াই আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পরিচালনা করে থাকি। প্রভাবমুক্ত প্রচার প্রচারনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্তিতি স্বাভাকি ও নিরপেক্ষ রাখা এবং অবাধ ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সমন্বয় করে পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকি। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করছি।
দৈনিক হুংকারে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।